নির্জন তাঁতঘরে
আমাকে রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াতে গিয়ে একঘরে হয়েছিলেন
বাবা। খড়ে ছাওয়া তাঁতঘর এ-কথা বেশ জানত।
রামকৃষ্ণ উৎসবের দিন আমরা দশম শ্রেণি
গামছা বিক্রি করব। বিকেলে ক্লাসের পর
চরকায় সুতো কাটা, আর অক্লান্ত তাঁতঘরের ভেতর
মাকুর ছোটাছুটি, হুল্লোর, লাল-সাদা সুতোর বুনোনে
অস্পষ্ট অন্ধকার জ্যোতির্ময় হয়ে উঠছে...
আপনি তখন কোথায়? সন্ধেবেলা ঠাকুরঘরে মাটির দাওয়ায় বসে
আমরা যখন চোখ বন্ধ করে ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম...’
গুনগুন করে যাচ্ছি, আপনি কি তখন ফ্রেম-বাঁধানো ছবি থেকে
নেমে এসে ধূপের ধোঁয়া সরিয়ে হাত রেখেছেন মাথায়?
নাকি তাও নয়। সটান সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে
মন্দির পেরিয়ে, মিশন পেরিয়ে, আমাদের ধীবরপাড়া দু-পায়ে মাড়িয়ে
অন্ধ নদীস্রোতে ঝাঁপ দিয়ে ফেলেছেন
পাঁকাল মাছের সাধনায়! অমলিন আলোয় তখন ভরে উঠেছে
আপনার প্রজ্ঞাপীড়িত মুখ! মৎস্যবণ্টনকালে সে মুখ
আমাদের দেখাই হল না।
সামনেই রামকৃষ্ণ উৎসব। আমরা দশম শ্রেণি
গামছা বিক্রি করব। বাবার একঘরে হয়ে থাকা এসো
যত মত এসো, তত পথ এসো, নির্জন তাঁতঘরে
আলপনা হয়ে ওঠো।
হাত পেতে দাঁড়ানো
অতঃপর সেই খেলাটা খেলতে খেলতে একদিন হঠাৎ
অদৃশ্য হয়ে গেলে! অদৃশ্য হওয়ার নানারকম কৌশল থাকে,
আমিও কিছু কিছু জানি। সরষেফুলের পাপড়ি থেকে উদে গিয়ে
মথের ডানার ভিতর বহুবার লুকিয়েছি। তুমি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে
কখনও ভুল করে বৃষ্টির কাছে
কখনও খোক্কসদের কাছে
হাত পেতে থেকেছ। আমি সময়মতন
ঝরে পড়তে পারিনি। কিংবা ঝরে পড়তে গিয়েও মরুঝড়ে
তালগোল পাকিয়ে
ফুরিয়ে গিয়েছি শূন্যতায়।
আজ সরষেফুলের ক্ষেত চিরে চিরে দেখছি। মথের ডানার ভেতর
নিরুদ্দিষ্ট তালিকায় লিখে রাখা তোমার ডাকনাম
তন্নতন্ন করে খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে এই বেলাশেষের আলো,
এই অনিঃশেষ দিকভ্রম
তীব্র মরুর ভিতর আমাকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
এবার আমিও কি একবার বৃষ্টিকণাদের কাছে, নাকি
খোক্কসদের কাছে, নাকি অন্য কোনো শূন্যের মহিমায়
হাঁটু গেঁড়ে
হাত পেতে দাঁড়াব?
জল
জল ভাবে না কিছুই, শুধু নিজের রাস্তাটুকু
প্রস্তত করে নেয়। আমি ঠিক কতভাগ জল, ভাবতে ভাবতে
তোমার মহিমার সামনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি। মহিমা অর্থাৎ
সেই রুক্ষ আর নির্জন শৃঙ্গ, যেখান থেকে গড়িয়ে নামতে নামতে
প্রবাহিত হতে হতে
জল আর পিছনে ফিরতে পারে না!
শধুই নিজের রাস্তাটুকু প্রস্তত করে এগিয়ে চলা...
এই-ই তবে ধর্ম হবে আজ? হে অন্তর্গত জল, বুকের সমস্ত পাথর একত্র করে
অঞ্জলি দিতে দিতে এই অবুঝ প্রশ্নটি নিয়ে
তোমার সামনে দাঁড়িয়েছি। তুমি কি যে-কোনো সংগঠন,
যে-কোনো স্থাপত্য ভেঙেচুরে এগিয়ে যেতে বলবে, নাকি
আমার উন্মুখ প্রস্তরসমষ্টিকেও কিছুটা গতিময় করে তুলবে!
আমার কতভাগ জল, ঠিক কতভাগ পাথরকে ঠেলতে ঠেলতে
কোন পথ প্রস্তত করে নিচ্ছে, আমি জানি না। কোনো এক নির্জন
আর রুক্ষ শৃঙ্গ
হয়ত জানলেও জেনে থাকতে পারে।
হরণ
যে যার মতন হরণ করছে আমাকে। করছ করো। বুক চিরে শুধু
আমার ছবি দেখাবার, অন্তত কেউ আছে। এই ভরসায়
হর্ষে পুলকে রাক্ষসীদের
ট্যাঁকের ভিতর পুষি। পোষ মানানো সহজ নয়,
ছোলা শরবত অপাঙক্তেও। বন্ধুদের কাটা ডানার ওপর দিয়ে
হিরের দেশে সোনার দেশে
আমাকে যখন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছ,
মজাই হল বেশ! হে সুন্দরী একবার তোমার
নাকটা দেখি। নথ পরাব কোথায়?
তুমি খিলখিল করে হেসে, মহাশূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে
আমাকে ছেড়ে পালালে...
তারপর এই একাই আছি। যদি কেউ আবার
হরণ করে, এক্কা গাড়ি দোক্কা গাড়ি, আমি তোমার
রথের চাকা, আমি তোমার গোলাপ, বারুদ। আমি তোমার
ফেরি-ঝুড়ির মনিহারি, খেলনাপাতি। যেভাবে খুশি
বাজিয়ে তোলো, মজাই হবে বেশ। বুক চিরে শুধু
আমার ছবি দেখাবার, অন্তত কেউ আছে। এই ভরসায়
আমি তোমার টিকালো নাক পরখ করে দেখি। দুষ্টু সোনা,
তরোয়ালের এক কোপে কেউ আগেভাগেই
কেটে দেয়নি তো? নথ পরাবার কালে
ধরাই পড়ে যাবে।
হরণ করার আগে নাক-বিষয়ে সুন্দরীদের
সর্তক থাকা ভালো।
মেঘজন্ম
নিরবধি এই মেঘজন্ম, এই ঝরে পড়া,
কেনো অমন শুষ্ক হয়ে থাকো! অর্জুনগাছের ছায়ায়
দাঁড়াতে ভয় পেলে, ফাঁকা মাঠে ঘাসের ওপর
বসতেও ভয়। যেন পৃথিবীতে আর ছায়া বলে কিচ্ছুটি নেই,
ঘাসও নেই, সবটুকুই মরুভূমি। আমি যে সংগোপনে
তোমার মাথার ওপর দিয়ে মেঘজন্মে ভেসে যাচ্ছি,
যে-কোনো মুহূর্তে ভিজিয়ে দেব বলে,
খেয়ালই রাখলে না!
হয়তো এমনই হয়। প্রত্যেকেরই এক-একটি নিজস্ব
মরুভূমি থাকে। সেখানে বৃষ্টিপাতের কোনো
ভূমিকা থাকে না। আমিও কোনোরকম ভূমিকা নেবার কথা
কল্পনা করিনি। সাগরে চুমুক দিয়ে, জলাশয় থেকে খামচে তুলে নিয়ে
যেটুকু কণা সংগ্রহ করতে পেরেছি, সেসব নিয়েই
ভেসে বেড়াচ্ছি এই একাকী নির্জনে।
কেনো অমন শুষ্ক হয়ে থাকছ? যত সামান্যই হই,
একবার সংগোপন ভেঙে টোকা দিয়ে দেখো।
তোমার অর্ধদগ্ধ বুক কিংবা ফুটিফটা ঠোঁট, তোমার অর্জুনগাছের বাগান
কিংবা আদিগন্ত সবুজ ঘাসের দিনলিপি
আমার এই মেঘজন্ম দিয়ে অন্তত একটুখানি
ভিজিয়েও দিতে পারি।
২৬ ডিসেম্বর, তোমাকে
আজ এই মেঘঢাকা প্রান্তরেখায় তুমি কেমন আছ
২৬ ডিসেম্বর? আমি তো আবার জন্মালাম তোমার সঙ্গে
দেখা হবে বলে। কুচিকুচি বরফকণার ভেতর জন্মালাম,
হিমেল হাওয়ায় উঁকি দেওয়া গ্ল্যাডিয়োলাসের
গোপন অনুরাগের ভেতর
জন্মালাম। তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিনা
জানা নেই। তবুও তো বারংবার জন্ম নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকা
যদি দেখা হয়ে যায়!
গত রাতে তুষারপাত হয়েছে খুব। আস্তাবল জুড়ে
ঘোর নৈঃশব্দ্য। প্রভুু কোথায় জন্মাবেন, ভেবে ভেবে অস্থির আমি
একটি তেজি ঘোড়ার কাছে করুণ মিনতি রেখেছি। সে তার
ঘাসবিচালি থেকে কিছুটা উপহার দেয় আমাকে। সে তার
তীক্ষ্ম পদতলের পাশে একফালি জায়গা করে দেয় আমাকে।
অতঃপর গোটা আস্তাবল জুড়ে মাতা মেরির কোল। তীক্ষ্ম অশ্বখুর,
অসংলগ্ন ভূমি মাতা মেরির কোল। যাবতীয় খড়বিচালি,
হিমঘোর নৈঃশব্দ্য মাতা মেরির কোল। প্রভু, এবার তো নিশ্চিন্তে
জন্মান। আপনি না জন্মালে ২৬ ডিসেম্বর আসে কেমন করে!
মেরুপ্রদেশের মতন শান্ত এই মেঘঢাকা প্রান্তরেখায় আমি যখন
জন্ম জন্ম অপেক্ষা করে থাকছি, তুমি কি আলগোছে
প্রভুকে কোল থেকে নামিয়ে একবার আমার দিকে
ফিরে তাকাতে পারো না ২৬ ডিসেম্বর?
সাক্ষাৎকার পড়তে ক্লিক করুন-
রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হওয়ায় আমরা সমাজ থেকে ছিটকে পড়েছিলাম : রফিক উল ইসলাম
***বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।